ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম বয়ে চলা জলপ্রপাত, সুউচ্চ বন পাহাড়, পাহাড়ের সারি সারি, ডাউকি ঝুলন্ত সেতু, পায়েন নদীর স্ফটিক স্বচ্ছ জল, পাহাড়ে আঁকড়ে থাকা বিশাল পাথর, নদীতে ফেলা পাথরের স্তূপ—এগুলো আবেগের ঢেউ তৈরি করে। পর্যটকের মন অল্প কথায়, চরিত্রে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যেমন, কাগজের ফুলে গাছের ফুলের অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
পর্যটকের চোখে জাফলংয়ের সৌন্দর্য
জিরো পয়েন্টে বাংলাদেশের পাহাড় থেকে ভারতের পাহাড়ে উঠা সুন্দর বাড়িগুলো দেখা যায়। ভারতের পাহাড়ে বাড়িগুলো অদ্ভুতভাবে উঠছে। এই দৃশ্য হৃদয়ে ভিন্ন তরঙ্গ পাঠায়। প্রকৃতি কন্যা, সৌন্দর্যের রানী, পিকনিক স্পট, সৌন্দর্যের স্থান হিসাবে জনপ্রিয় জাফলং দর্শনার্থীদের কাছে কল্পনার জগত।
সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত জাফলং একটি পর্যটন স্পট। এটি ভারতের মেঘালয় সীমান্তে খাসিয়ার জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত।
ঐতিহাসিকদের মতে, হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল নির্জন বনভূমি। খাসিয়ার জৈন্তা রাজারা সেখানে রাজত্ব করতেন। ১৯৫৪ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে তাদের রাজত্বের অবসান ঘটে। কয়েক বছর পর জাফলং বেকায়দায় পড়ে। পরে নদীপথে পাথর ব্যবসায়ীরা এখানে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে নতুন বসতি। ১৯৮০ সালে, জাফলং এবং সিলেটের মধ্যে ৫৫ কিলোমিটার রাস্তা স্থাপিত হয়। এরপর থেকে জাফলংয়ের অপরূপ সৌন্দর্যের খবর ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাফলং সেজে ওঠে নানা সাজে। শীত ও বর্ষা মৌসুমে জাফলং তার সৌন্দর্য প্রদর্শন করে। জাফলং বর্ষাকালে বিভিন্ন মাত্রায় ফুল ফোটে। ধুলোময় পরিবেশ হয়ে ওঠে পরিষ্কার, নির্মল। খাসিয়া পাহাড়ের সবুজ শৃঙ্গের ওপরে মেঘরাজি তুলোর মতো ঘুরে বেড়ায়। এছাড়াও, কয়েক হাজার ফুট থেকে সাদা জলপ্রপাতের দৃশ্য সমস্ত সৌন্দর্য প্রেমীদের জন্য একটি দৃশ্য।
ভারত সীমান্তে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে মৌসুমি বায়ু নদীর প্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। নদী সজীব হয়ে ওঠে, আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে। বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখ ঘিরে জাফলংয়ে একটি বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। এ মেলাকে ঘিরে জাফলং এলাকা মুখরিত। বর্ষাকালে পিনাইন নদীর পানি উপচে পড়লেও শীতকালে পানির স্তর সম্পূর্ণ নেমে যায়। পায়ে হেঁটে নদী পার হতে পারেন। স্বচ্ছ পানি ও পাথরের গঠন দেখতে শীতকালে জাফলংয়ে আসা পর্যটকরা প্রকৃতির এক অনন্য স্বাদ উপভোগ করতে পারেন।
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এখানে ভিড় জমায়। দেশি-বিদেশি পর্যটক ছাড়াও প্রকৃতিপ্রেমীরাও ছুটে আসেন জাফলংয়ে। জাফলং এখন দেশের অন্যতম সেরা পর্যটন স্পট।
জাফলং বিখ্যাত কেন?
জাফলং বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের একটি পাহাড়ি স্থান এবং একটি পর্যটন কেন্দ্র। এটি সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত এবং এটি বাংলাদেশ ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত, যা উপক্রান্তীয় পর্বতমালা এবং রেইনফরেস্ট দ্বারা আচ্ছাদিত। এটি পাথর সংগ্রহের জন্য পরিচিত এবং খাসি উপজাতির আবাসস্থল।
সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ
- ডিবির হাওর
- হাকালুকি হাওর
- লালাখাল
- রাতারগুল
- বিছনাকান্দি
- ভোলাগঞ্জ
- লোভাছড়া
- সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা
- পান্থুমাই ঝর্ণা
- লক্ষনছড়া
- জাফলং
- তামাবিল
- জিতু মিয়ার বাড়ী
- আলী আমজদের ঘড়ি
- ক্বীন ব্রীজ
- শ্রীমঙ্গল
- আদমপুর বন
- মাধবপুর লেক
- লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
- মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি
- টাঙ্গুয়ার হাওর
- নীলাদ্রি লেক
- যাদুকাটা নদী
- শিমুল বাগান
- বারেক টিলা
- লালঘাট ঝর্ণা
- সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান
হাকালুকি হাওর
হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওর। এটি মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় অবস্থিত। হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮১.১৫ বর্গকিলোমিটার। হাওর ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। হাকালুকি হাওয়ারে প্রায় ২৩৮টি হাওর রয়েছে। হাকালুকি হাওরে রয়েছে প্রচুর মৎস্যসম্পদ। হাওর চূড়াগুলো অনেক প্রজাতির দেশীয় মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। হাকালুকি হাওরের হাওরে রয়েছে নানা বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ।
ভ্রমণের সেরা সময়: এপ্রিল-অক্টোবর এই জায়গাটি দেখার সেরা সময়।
রাতারগুল
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র মিঠা পানির জলাভূমি এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বনটি ৩,৩২৫.৬১ একর এলাকা জুড়ে রয়েছে, যার মধ্যে ৫০৪ একরকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। সমগ্র বিশ্বে মাত্র ২২টি মিঠা পানির জলাভূমি রয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে আছে দুটি। একটি শ্রীলঙ্কায় এবং আরেকটি বাংলাদেশের রাতারগুলে। এই সুন্দর এবং বিস্তীর্ণ বনকে শুধুমাত্র আমাজনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আমাজনের মতো এখানকার গাছগুলো বছরে ৪ থেকে ৭ মাস পানির নিচে থাকে। এই বনটি মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও বাংলাদেশ বন বিভাগ বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ বিভিন্ন ধরনের পানি সহনশীল গাছ লাগিয়েছে।
এছাড়াও এই প্লাবিত বনে রয়েছে হিজল, করচ ও বরুন গাছ, পিঠালি, অর্জুন, চাটিম, গুটি জাম ও বটগাছ। এই বনে অনেক সাপের আবাস রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বানর, সাপ, সাদা পুরুষ, কানা পুরুষ, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুল, পানকৌড়ি, ধুপি, কবুতর, মরিচ ও বাজপাখি।
ভ্রমণের সেরা সময়: আপনি বছরের যেকোনো সময় এখানে যেতে পারেন। তবে এর আসল সৌন্দর্য বর্ষাকালে দেখা যায়।
বিছনাকান্দি
বিছনাকান্দি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে খাসিয়া পাহাড়ের অনেকগুলো ধাপ উভয় দিক থেকে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। পাহাড়ের ঘাটে রয়েছে একটি সুউচ্চ ঝরনা।
এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল পাথরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের প্রবাহ। পূর্ব দিক থেকে পিয়াইন নদীর একটি শাখা পাহাড়ের নিচ দিয়ে ভোলাগঞ্জের দিকে চলে গেছে। বিছনাকান্দি পাহাড়, নদী, ঝর্ণা ও পাথরের প্রাকৃতিক ও সম্মিলিত সৌন্দর্য।
ভ্রমণের সেরা সময়: বিছনাকান্দি ভ্রমণের সেরা সময় বর্ষাকাল।
ভোলাগঞ্জ
দেশের বৃহত্তম পাথর কোয়ারি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে অবস্থিত। বর্ষাকালে মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে পানি প্রবাহিত হয়। পাথর ধলাই নদীতে প্রবাহিত হয় এবং পরবর্তী বর্ষা না আসা পর্যন্ত পাথর উত্তোলন চলতে থাকে। একটি বিশেষ কোয়ারি মোটর বোট দ্বারা ২০ মিনিট দূরে অবস্থিত। মূলত, এই জায়গাটিকে একটি বিশেষ কোয়ারি বলা হয় কারণ এটি সীমান্তের খুব কাছে। সেখান থেকে আপনি প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।
চেরাপুঞ্জির নীচে: চেরাপুঞ্জি, বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা, ভারতের পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়ে অবস্থিত। এই রাজ্যের অবস্থান ধলাই নদীর উজানে। খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় ঘেরা এই রাজ্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই সুন্দর। ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে এলাকায় অবস্থিত, পাহাড়ের মনোরম দৃশ্যের সাক্ষী হতে পারে। বর্ষাকালে চেরাপুঞ্জি থেকে আসা বৃষ্টির পানি ধলাই নদীতে পাহাড়ি স্রোত তৈরি করে।
ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে: ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে বয়ে যাওয়া ধলাই নদী প্রতি বছর বর্ষাকালে অনেক পাথর বয়ে নিয়ে যায়। ধলাই নদীতেও পাথরের বিশাল মজুদ রয়েছে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যে ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্পটি ২০০ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, এলাকাটি দেখতে ব-দ্বীপের মতো।
ভোলাগঞ্জ স্থল শুল্ক স্টেশন: ভোলাগঞ্জে একটি স্থল শুল্ক স্টেশন রয়েছে। এই স্টেশনের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মূলত এই স্টেশন দিয়ে চুনাপাথর আমদানি করেন। প্রতিদিন শত শত ট্রাক চুনাপাথর বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সীমান্তের জিরো লাইনে এই কাস্টমস অফিসের অবস্থান। আমদানি করা চুনাপাথরের দৃশ্যও পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়।
শ্রীমঙ্গল
চায়ের রাজধানী হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত একটি উপজেলা। এটি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এই অঞ্চলে রয়েছে পাহাড়, রেইনফরেস্ট, হাওর ও সবুজ চা বাগান। শ্রীমঙ্গলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে চা বাগান। দেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ৪০টি এ উপজেলায় অবস্থিত।
এছাড়া শ্রীমঙ্গলে রাবার, লেবু ও আনারসের চাষ হয়। পাহাড়ি ও ঘন বনাঞ্চলে বৃষ্টিপাত বেশি হয়, তাই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গলের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে কালাপুর ইউনিয়ন গ্যাসক্ষেত্র, খনিজ সমৃদ্ধ সিলিকা বালি শ্রীমঙ্গল বালি এবং মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র।
আপনি কি জানেন ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন গভীর রাতে মাগুরছড়া গ্যাস কূপ খননের সময় আগুনে বিস্ফোরণে খাসিয়াপুঞ্জির আশপাশ, চা বাগান, রেললাইন ও সবুজ বনাঞ্চল পুড়ে ছাই হয়ে যায়? এই গ্যাস কূপটি এখন পরিত্যক্ত এবং একটি সংরক্ষিত এলাকা। এলাকায় কিছু প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে।
মাধবপুর লেক
মাধবপুর লেক ও চা বাগান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। দর্শনীয় মাধবপুর হ্রদটি ছোট ছোট পাহাড় ও টিলার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। লেকের আশেপাশের টিলা ও টিলায় বেশির ভাগই চা তৈরির জন্য চাষ করা হয়।
এই হ্রদের জল সবসময় নীল এবং সাদা পদ্ম ফুলে আবৃত থাকে। লেকটি এতটাই প্রশস্ত যে পুরো লেকটি ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। হ্রদটিকে একটি শান্ত নদী বা সমুদ্রের মতো দেখায় কারণ প্রায় সবসময়ই লেকের উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায়। এই লেকের নীল-সাদা পদ্মফুলগুলো দূর থেকে এতই ঝলমল করে যে মনে হয় পদ্ম ফুলের ওপর কেউ কোনো শৈল্পিক কাজ করেছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর
টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি এবং প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। উপহ্রদ, নীল আকাশ, পাহাড় এবং চোখ ধাঁধানো গাছপালা এই হাওয়ারকে অনন্য করে তুলেছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন ৬৯১২ একর।
তবে বর্ষাকালে এ হাওরের আয়তন প্রায় ২০ হাজার একর হয়ে যায়। শীতকালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির পাখি এখানে পরিযায়ী হয়। টাঙ্গুয়ার হাওড় থেকে ভারতের মেঘালয় পর্বতমালা দেখা যায়। মেঘালয়ের প্রায় ৩০টি ছোট-বড় ঝরনা বা ঝরনা টাঙ্গুয়ার হাওরে মিলিত হয়েছে।
টাঙ্গুয়ার হাওর দেখার সেরা সময়: টাঙ্গুয়ার হাওর দেখার সেরা সময় বর্ষা। তবে পাখি দেখতে হলে শীতকালে যেতে হবে।